শিশির ভট্টাচার্য্য-এর ‘উচিৎ শিক্ষা’ বইয়ের আলোচনা - আসলাম আহসান

শিশির ভট্টাচার্য্য লিখিত ‘উচিৎ শিক্ষা’ বই



বইয়ের নাম ‘উচিৎ শিক্ষা’। নাম পড়েই মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটবে, সন্দেহ নেই। গুরুগম্ভীর বিষয়ও মজার ভঙ্গিতে কতটা কার্যকরভাবে বলা যায়, এ বই তার সুন্দর উদাহরণ।

কিছু দিন আগে শিক্ষা বিষয়ক কিছু রেফারেন্স বই খুঁজছিলাম। ‘বাতিঘর’ তোলপাড় করে পাওয়া গেল গোটা পাঁচেক বই। কিন্তু ‘সকলই গরল ভেল’! যে স্তরের বই খুঁজছিলাম, এগুলো তেমন না। শিশির ভট্টাচার্যের লেখা ‘উচিৎ শিক্ষা’ বইটা নিলাম শুধু নামের ব্যঞ্জনায় প্রলুব্ধ হয়ে।

বছর চারেক আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একবার তাঁর আলোচনা শোনার সুযোগ হয়েছিল। যখন কক্ষে প্রবেশ করেছি, দেরি হয়ে গিয়েছিল; বক্তা তাঁর বক্তব্যের জাল প্রায় গুটিয়ে এনেছেন। কথা বলছিলেন ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ বিষয়ে। প্রতিটা বাক্য শানিত। শেষ কথাটা কানে লেগে আছে। ‘আমার কথায় কেউ যদি আহত বোধ করে থাকেন, তাহলে ক্ষমার মলমটা নিজ দায়িত্বে লাগিয়ে নেবেন!’ ক্ষমাপ্রার্থনার কী তীর্যক ভঙ্গি!

কে কী বুঝল জানি না, আমি বুঝে নিলাম, তিনি গহীনের মানুষ। পরে জেনেছি শিশির ভট্টাচার্য্য ভাষাবিজ্ঞানী। ভাষাবিজ্ঞানে তিনি পি.এইচ.ডি. (২০০৭) করেছেন কানাডার মন্ট্রিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্যারিসের সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞানে এম.ফিল. (১৯৯৫) ও এম.এ. (১৯৯৪) করেছেন। তাঁর অধিকাংশ কাজই ভাষা নিয়ে।

তো, এমনি করে ক’দিন আগে হাতে এলো বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর বই ‘উচিৎ শিক্ষা’। একদম প্র্যাকটিক্যাল গ্রাউন্ড থেকে বইটি লেখা। পড়ে তথ্য ভারাক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। বাঁচিয়ে দিয়েছে লেখকের সরস ও আন্তরিক ভাষাভঙ্গি। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে বলতে গিয়েও স্বভাবসুলভ পান [pun] ও রসিকতা ছাড়েননি। ভাগ্যিস ছাড়েননি, নয়তো পাঠক হিসেবে আমাকেই হাল ছাড়তে হতো!   

গবেষণামূলক বই পড়ে আনন্দ পাওয়া কঠিন; তবে আমি পেয়েছি। মনে হচ্ছিল লেখকের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি! লেখক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বই ছাড়া এমন অনুভূতি আর কারো ক্ষেত্রে হয়েছে কি না, মনে করতে পারছি না। চিন্তার কিছু নতুন সূত্র পাওয়া গেল। শেষ করে মনে হলো, বইটা নিয়ে কিছু লেখা দরকার। হতেও পারে, আমার মতো আরও অনেকেরই দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে এই প্রয়োজনীয় বইটি।  
    
মোট আঠারোটি প্রবন্ধ। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রবন্ধের শিরোনাম : মূর্খদের কেন ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে, কেমন শিক্ষক চাই, হাসি হাসি প্রশ্ন ফাঁসই দেখছে বঙ্গবাসী, লেখাপড়া করে যে, সিলেবাসে কী থাকা উচিৎ, বইপড়ানি মাসি-পিসি মোদের বাড়ি এসো, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি, বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে শুরু হলো, পণ্ডিত মশায়ের বেতন সায়েবের কুকুরের কয়টি ঠেঙের সমান।

এ বইয়ে মৌলিক কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছেন লেখক। উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার নজির টেনে চোখে আঙুলি দিয়ে দেখিয়েছেন আমাদের পশ্চাদপদতা কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সতর্ক করেছেন:  নিছক ডিগ্রি দেখিয়ে আশানুরূপ কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন কমে আসছে। উত্তর আমেরিকায় একজন কলেজ বা স্কুলপাস শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়পাস শিক্ষার্থীর তুলনায় বেশি বেতনের চাকরি পাচ্ছে। কারণ ছাত্রজীবনে সে লেখাপড়া ছাড়াও সংগীত করেছে, নাটক করেছে বা বিপন্নের সেবায় এগিয়ে এসেছে।

তিনি মনে করেন,

শিক্ষকতা একটি কলা এবং যেকোনো কলাই একটি বিরল জন্মগত প্রতিভা। মনে রাখার মতো শিক্ষক হাতেগোনা। এর একটি প্রমাণ, ১১০০ থেকে ১৫০০- মধ্যযুগের এই পাঁচশ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে পাঁচজনের বেশি বিখ্যাত শিক্ষকের কথা জানা যায় না, যদিও একই সময়ে বহু জ্ঞানী ব্যক্তির কথা জানা যায়।


শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তিনি খুঁজতে পরামর্শ দিয়েছেন এমন ব্যক্তিকে যার ভেতরে শিক্ষক হওয়ার সহজাত প্রেরণা রয়েছে। প্রশ্ন রেখেছেন, শিক্ষক হওয়ার কোনো প্রকার প্রেরণা বা আগ্রহ যার নেই, তাকে হাজার প্রশিক্ষণ দিয়েও কি কোনো লাভ হয়? ইস্পাত দিয়ে  ভালো ছুরি তৈরি হয়; কাঁচা লোহাকে পেটানো পণ্ডশ্রম। অভিজ্ঞতা দিয়েও প্রেরণা বা প্রতিভার ঘাটতি মেটানো যায় না, অন্ততপক্ষে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে।
(পড়তে পড়তে মনে হলো, বছরের পর বছর কাঁচা লোহা পেটানোর এই পণ্ডশ্রমটা কী নিষ্ঠার সঙ্গেই না আমরা করে চলেছি!)

নিছক ডিগ্রি দেখিয়ে আশানুরূপ কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন কমে আসছে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বেহুদা ডিগ্রি-লোলুপতা বিরাজ করছে, তিনি এর বিলুপ্তি কামনা করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, কৃষিতে যার আদৌ আগ্রহ নেই, তাকে কেন কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিতে হবে? কৃষিবিজ্ঞানে যার স্নাতক ডিগ্রি আছে, তাকেই-বা কেন ব্যাংকে চাকরি করতে হবে? এগুলো নেহাতই ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রের সময়, সামর্থ্য ও অর্থের অপচয়। ব্যাংক বা আমলাতন্ত্র সামাল দেওয়ার জন্য মাধ্যমিকের পর চার বছরের সাধারণ কলেজ ডিগ্রিই কি যথেষ্ট হওয়া উচিত নয়? কোনো বিশেষ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ যাদের নেই, তারা সেই কলেজ ডিগ্রি নিয়ে কর্মজীবনে ঢুকে যাবে। সেই সাধারণ কলেজ-ডিগ্রির সিলেবাসে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, আইন ইত্যাদিসহ এমন অনেক বিষয়ই থাকবে, যেগুলো একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখতে পারে।   

প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে বহু আগে যিনি বলেছিলেন :

ছেলে যদি মানুষ করিতে  চাই, তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে, নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না।


পর্যবেক্ষণে ড. শিশির দেখেছেন, কানাডার কুইবেকের ফরাসি স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে শেখানো প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। ছাত্রেরা ফরাসি বা ইংরেজি ব্যাকরণে দুর্বল থাকলেও ফরাসি বা ইংরেজি কমবেশি শুদ্ধভাবে লিখতে পারে। বাংলাদেশে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ- প্রতিটি ক্লাসে বাংলা ব্যাকরণের মোড়কে সংস্কৃত ব্যাকরণের পুনরাবৃত্তি করাতে গিয়ে যে সময় অযথা নষ্ট হয়, সেটা লিখতে শেখানোর কাজে ব্যবহার করা যেত। ছাত্ররা লিখতে জানে না, কারণ আমরা লিখতে শেখাই না। শুধু লিখতে কেন, শিক্ষার্থীদের যুক্তিসম্মতভাবে গুছিয়ে কথা বলতেও শেখানো হয় না।  

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন তিনি। একবার আইনস্টাইনকে এক মা জিগ্যেস করেছিল, আমার ছেলেকে বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। কী করতে হবে? আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন,

ওকে রূপকথা পড়ে শোনান। আর যদি আমার চেয়েও বড় বিজ্ঞানী যদি বানাতে চান, তবে তাকে আরও বেশি করে রূপকথা শোনান!


প্রশ্ন তুলেছেন লেখক, বাংলাদেশে বাংলা ও ইংরেজি রচনা মুখস্থ করার প্রচুর বই থাকলেও মনের ভাব প্রকাশ করে লিখতে শেখানোর কোনো বই নেই কেন? এর মানে কি এটাই যে, নীতিনির্ধারকেরা চান শিক্ষার্থীরা রচনা মুখস্থ করুক! মুখস্থ করার কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। আগে কবিতা বা ছড়া মুখস্থ করার একটা প্রথা ছিল। গত কয়েক দশকে সে প্রথা বাতিল হয়েছে, সম্ভবত কোনো একদল অদূরদর্শী শিক্ষাবিদের পরামর্শে: ‘মুখস্থ করা চলবে না, সবাইকে সৃজনশীল হতে হবে!’ ভুল চিন্তা।   

‘তোতাকাহিনী’র প্রত্যাবর্তন চান না লেখক। চান শিক্ষার্থীরা নানা বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠুক। চান শিক্ষকগণ তাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখাবেন সক্রেটিসের মতো। কারণ একটি উপযুক্ত প্রশ্ন হাজারো অনুপযুক্ত উত্তরের চেয়ে উত্তম। রাজেন্দ্র সিংহ (লেখকের শিক্ষক) তাঁর সুহৃদ নোয়াম চমস্কি সম্পর্কে বলেছেন,

অন্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে চমস্কির তফাত হচ্ছে এই যে, তিনি সঠিক প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু সঠিক উত্তর হয়তো খুঁজে পাননি। অন্যেরা প্রশ্নই ভুল করেছেন, সুতরাং উত্তর সঠিক হওয়ার প্রশ্নই আসে না।


পৃথিবী দ্রুত আগাচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে শিক্ষাপদ্ধতি। কেমন হতে পারে আগামীর শিক্ষা? একটা রূপরেখা এঁকেছেন লেখক। তিনি মনে করছেন, ভবিষ্যতে পুরো শ্রেণিকক্ষই ভার্চুয়াল হয়ে যেতে পারে। সেখানে আধুনিক ভিডিও গেমের মতো এক একজন ভার্চুয়াল শিক্ষার্থী  বা শিক্ষার্থীর হলোগ্রাম একটি বিষয়ে যত রকম প্রশ্ন করা সম্ভব, একে একে করতে থাকবে। শিক্ষার্থী প্রশ্নোত্তর শুনবে, এমনকি আলোচনায়ও অংশ নিতে পারবে। কম্পিউটারে বা অন্য কোনো ডিভাইসে ভার্চুয়াল শিক্ষাপ্রোগ্রাম চালু করার সঙ্গে সঙ্গে প্রোগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের শিক্ষার্থীও হয়ে যাবে একজন ভার্চুয়াল শিক্ষার্থী। শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীর অগ্রগতি নির্ধারণ, বিশেষ শিক্ষার্থীর বিশেষ সমস্যা খুঁজে বের করা ইত্যাদি সবকিছুর দায়িত্ব নেবে সেই ভিডিও-শিক্ষা প্রোগ্রাম।


আমার কথায় কেউ যদি আহত বোধ করে থাকেন, তাহলে ক্ষমার মলমটা নিজ দায়িত্বে লাগিয়ে নেবেন!

চিত্রটা আশা-জাগানিয়া, না আতঙ্কের? লেখক মনে করছেন, ভার্চুয়াল শিক্ষা চালু হলে উচ্চশিক্ষার্থে তখন বিদেশ-গমনের প্রয়োজন হবে না, ফলে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কষ্টার্জিত অর্থ উন্নত দেশের কোষাগারে পাচার হবে না। লিভারপুলের শিক্ষার্থী যা শিখবে, হাতিরপুলের শিক্ষার্থীও অনেকটা তা-ই শিখবে। সিঙ্গাপুরের মিউজিয়ামে গিয়ে যা দেখা যাবে, ঠিক তা-ই দেখা যাবে মিরপুরে, নিজের ট্যাবলেটের ত্রিমাত্রিক জাদুঘরে।

পুরো বই জুড়ে শিক্ষার তিন অংশীদার: শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সরকারকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন শিশির ভট্টাচার্য্য। পরামর্শগুলো কাজে লাগানো গেলে লাভবান হবে সবাই। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।      
 

************
উচিৎ শিক্ষা
শিশির ভট্টাচার্য্য


প্রকাশক : আদর্শ, ঢাকা, বাংলাদেশ
প্রকাশকাল: ২০১৮
পৃষ্ঠা: ১৫২

ISBN: 9789-984-9266-40-2

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ