বাহারবন্দ পরগনা সেকালের কাশিমবাজার রাজস্টেটের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশাসনিক এলাকা। এখানকার ইতিহাস-ঐতিহ্য অত্যন্ত সুগঠিত এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে এই এলাকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশাসনিক এলাকা। এ সম্পর্কে বলতে গেলে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে— উপযুক্ত নথিপত্র এবং ইতিহাসবিদেরা যে তথ্যগুলো আমাদের মাঝে উপস্থাপন করেছেন, —সেই তথ্যগুলোকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক সমীক্ষা জানার আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মো. মঈনুল হাসানের ‘বাহারবন্দ পরগণার ইতিহাস ও মহারাণী স্বর্ণময়ী’ বইটি খুলে অতীত ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া যাক।
বইটি মূলত বাহারবন্দ পরগনার অন্তর্গত প্রশাসনিক অঞ্চল উলিপুরকে কেন্দ্র করে এই বইটি রচিত হয়েছে। পাশাপাশি মহারাণী স্বর্ণময়ীর জীবনের ট্রাজেডি উঠে এসেছে— ক্ষমতার পালাবদলে। প্রথমে বইটির প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে আমরা নেড়েচেড়ে দেখবো এবং কাঠামোগুলোকে একটা নির্দিষ্ট স্তরে নিয়ে গিয়ে আগ্রহের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে। এই বইয়ের বিষয়গুলিকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি— পূর্বভাগ, মধ্যভাগ এবং উত্তরভাগ। পূর্বভাগে— বাহারবন্দ পরগণা এবং তৎকেন্দ্রিক রাজাদের পরিচয় পর্ব, মধ্যভাগে— মহারাজা কৃষ্ণকান্ত নন্দীর মৃত্যু এবং মহারাণী স্বর্ণময়ীর জীবনে রাজকার্য পরিচালনার ট্রাজেডি এবং উত্তরভাগে— বাহারবন্দ পরগনার রাজস্ব প্রশাসন, ঐতিহ্য ও উপেক্ষিত কথামালার প্রাসঙ্গিক আলোচনা।
★ পূর্বভাগ— কি? কেন? কীভাবে?
রাজকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে রাজস্ব আদায়ের জন্য বৃহৎ অঞ্চলকে ছোট ছোট আকারে ভাগ করা হয়, পরগনা নামে। সুলতানি শাসনামলে পরগনা শব্দটির সর্বপ্রথম প্রচলন ঘটে। সেসময় একগুচ্ছ গ্রাম মিলে একটি পরগনা হতো। কেন্দ্রস্থল দ্বারা সেই জায়গার রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হতো। তবে প্রতিটি পরগণার খাজনা বৃদ্ধি, কৃষি ক্ষেত্রে নতুন পরিমাপের মানদণ্ড এবং নিজস্ব নিরিখ ছিল, আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য! কিন্তু একটা সময় এসে পরগনার রায়তগণ রাজকার্যের প্রতি অবহেলায় জড়িয়ে পড়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে! তারা সরকারি ব্যবস্থাপনাকে স্বীকৃতি দিতে চান না। এভাবেই চলতে থাকে অনেক বছর। তারপর ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে পরগনা পদ্ধতিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা হয়। পরবর্তিতে ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থাপনার দ্বারা জমিদারদের নির্ধারিত ভূমির মালিকানা প্রদান করে। এভাবেই পরগনা শব্দটির প্রয়োগ ধীরে ধীরে কমে যায়। তেমনই একটি পরগনা ছিল, বাহারবন্দ পরগনা। প্রথমত, বাহারবন্দ পরগনার সদর দপ্তর ছিল ধামশ্রেণী। পরে, ১৭৭৭ সালে উলিপুরে স্থানান্তর হয়। জড়িয়ে পড়ে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে—এর পরিধি ছিল ৫২০ বর্গমাইল। কুড়িগ্রাম, রৌমারী, রাজীবপুর, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর ও গাইবান্ধার অনেকাংশে বাহারবন্দ পরগনার বিস্তৃতি ছিল।
রাণী ভবানী থেকে দেবী চৌধুরানী, কৃষ্ণকান্ত নন্দী থেকে শ্রীশচন্দ্র নন্দী —এই অঞ্চল এক সময় দাপিয়ে বেড়াতেন। এমনকি মীর জুমলার বাহিনীর আসাম অভিযান —এই পথ ধরেই হয়েছিল। ফকির-সন্ন্যাসীদের আনাগোনা ছিল এই অঞ্চলে। এই বইটি থেকে জানতে পারি, তৎকালীন কোচরাজ্যের রাজা মহারাজ বিশ্বসিংহ তার রাজ্যের দক্ষিণ সীমা সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে করোতোয়া থেকে ব্রহ্মপুত্র তীর পর্যন্ত এক বিশাল মাটির প্রাচীর বা বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। এই বাঁধের যে অংশটি বাঁধের ভিতরে ছিল, সেই অংশটি ভিতরবন্দ এবং বাহিরের অংশটি বাহারবন্দ নামে পরিচিত হয়।
—এই অঞ্চলটাকে প্রাগজ্যোতিষপুর বলা হয়। প্রাগজ্যোতিষপুর সম্বন্ধে অনেক লোকশ্রুতি আছে, জানা যায় প্রাগজ্যোতিষপুরের কোন একটি জায়গায় বসে ব্রহ্মা তাঁর সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করেন। কবিশেখর কালিদাস রায় যখন উলিপুরে মহারানী স্বর্ণময়ী স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন, ওই সময় তিনি এই অঞ্চলকে প্রাগজ্যোতিষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার কবিতায়। এখানকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সুদৃঢ় ও সুবিন্যস্ত। মহাভারতীয় মহারথীগণ ঐসময় এইখানটায় বসতি স্থাপন করেছিলেন, মহাভারত গ্রন্থে এইসব কথা পাওয়া যায়। এই গল্পগুলোর পিছনে কিছু লোকশ্রুতি আছে, ঐতিহাসিক সম্ভাবনা খুব কম। তেমন একটি গল্প এখানে তুলে দেওয়া হয়েছে, ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন এবং অর্জুন কর্তৃক নিহত হন। সেই ভগদত্ত নাকি রঙ্গপুর স্থাপন করেছিলেন। এর পিছনে উপযুক্ত কোন নথিপত্র নেই। তাই এই বিষয়গুলোকে প্রাসঙ্গিক বলে মেনে নেওয়াটা ঠিক হবে না। তবে জানা যায়, ভগদত্ত বংশীয় মহারাজা পৃথু’র রাজ্য পঞ্চগড়ের বোদা ও বৈকুণ্ঠপুরের ভিতরগড় ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান।
রংপুর অঞ্চলে সবচেয়ে বড় রাজবংশগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে খেন রাজবংশ। ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে উদ্ভব। এরা ছিলেন শক্তির উপাসক। অহম ভাষায় খেন অর্থে উত্তম বা রাজা। ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে এই বংশের রাজা নীলাম্বর কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার পাঙ্গায় কোটেশ্বরী মন্দির নির্মাণ করেন। কোটেশ্বর হচ্ছে শিবের একটি নাম। কোটেশ্বর বা কোটি + ঈশ্বর নামটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থ বহন করে তাই এই নামে খুব কম মন্দির দেখা যায়। যতদূর জানি, বাংলাদেশে এই নামে শুধু একটাই মন্দির আছে। এই রাজার রাজধানী ছিল চতরায়। গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সাথে যুদ্ধে ১৪৯৮ সালে রাজা নীলাম্বর পরাজিত হন এবং এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এবং ১৫০৬ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক একটি মসজিদ নির্মাণ হয় উলিপুরে।
১৫ শতাব্দীর শেষভাগে কামতাপুর বিজয়ের পর গৌড়ের সুলতান জনৈক জগৎ রায় নামক এক ব্রাহ্মণকে চারটি পরগনা দিয়েছিলেন— ভিতরবন্দ, বাহারবন্দ, পাতিলদহ ও স্বরূপপুর। এরপর একের পর এক ক্ষমতার পালাবদল হয়, মহারাজা বিশ্বসিংহ থেকে মোঘল রাজত্ব সবকিছু পেরিয়ে একসময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কাশিমবাজার রাজ স্টেট। এটি ছিল বাহারবন্দ পরগনার অন্তর্ভুক্ত একটি প্রশাসনিক এলাকা। যা ধামশ্রেণীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। আর এই ধামশ্রেণীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রঘুনাথ রায় যিনি রাণী সত্যবতীর স্বামী ছিলেন। তিনিই প্রথম এই অঞ্চলে বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্রাহ্মণ নিয়ে এসে বসতি স্থাপন করে দিয়েছিলেন এবং ৪০০ একর জমি দেবোত্তর হিসেবে দিয়েছিলেন।
এইখানটায় বেশ কয়েকটি পুরনো মন্দির আছে, ইতিহাসবিদরা মনে করেন এগুলো ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জানা যায়, রানী ভবানীও ছিলেন এই জায়গাটার জমিদার। রানী সত্যবতী ধামশ্রেণী তুলে দিয়েছিলেন তার ভগ্নিপুত্রী মহারানী ভবানীর হাতে।
★ মধ্যভাগ— কৃষ্ণকান্ত নন্দী থেকে মহারানী স্বর্ণময়ী
কাশিমবাজার রাজবংশীর প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণকান্ত নন্দী। যিনি মহারানী স্বর্ণময়ীর স্বামী ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসকে বিপদাপন্ন অবস্থায় সাহায্য করেছিলেন বলে, রানী ভবানীর কাছ থেকে জোর করে —এর প্রতিদান স্বরূপ জমিদারি কেড়ে নিয়ে কৃষ্ণকান্ত নন্দীকে দিয়েছিলেন। এই কথাটি লেখক স্পষ্ট করে বলেছেন। কৃষ্ণকান্ত নন্দী ভুয়া হত্যা মামলায় জড়িয়ে পড়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন— আত্মসম্মান রক্ষার্থে তিনি ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন। এরপরেই, রাজ্যভার চলে যায় মহারানী স্বর্ণময়ীর হাতে কিন্তু এই অভিযানটা কোনক্রমেই সহজ ছিল না, তাকে সারদাময়ী থেকে হয়ে উঠতে হয়েছিল— মহারাণী স্বর্ণময়ী।
নানা রকম মামলা মোকদ্দমার মধ্য দিয়ে, তিনি তার রাজ্যভার বুঝে পেয়েছিলেন— তার হাত ধরেই, বাহারবন্দ পরগনায় নারী শাসনের সূচনা হয়। উলিপুরে গড়ে তুলেছিলেন একটি ইংরেজি স্কুল। এই স্কুলটি ১৮৬৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মঞ্জুরী লাভ করে। স্কুলটিতে চাকরি করেছিলেন, কবি শেখর কালিদাস রায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পরিবেশগত প্রভৃতি উন্নয়নে মহারাণীর বিভিন্ন পদক্ষেপ বাহারবন্দ পরগণাকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিল।
মহারানী স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর পর এ রাজ্যভার চলে যায় রানী হরসুন্দরীর হাতে, তারপর আসেন রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। তিনি ছিলেন, উচ্চশিক্ষিত ও শিক্ষানুরাগী। আর রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর মৃত্যুর পর রাজ সিংহাসনে বসেন তার কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র নন্দী। তিনি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। যোগাযোগ ও পূর্ত দপ্তর ছিল তাঁর অধীনে। নানাভাবে মানুষের উপকার করে তিনি মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন।
★ উত্তরভাগ ও তৎপ্রসঙ্গ:
শেরশাহ সমগ্র বাংলাকে খাজনা আদায়ের নিরিখে ১৯টি সরকারে ভাগ করেছিল। তারমধ্যে ঘোড়াঘাট -এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বাহারবন্দ পরগণা। এই অঞ্চলে যিনি খাজনা আদায়ের দায়িত্ব পালন করতেন তার পদবী পাটোয়ারী। পরবর্তীতে শাহাজাদা সুজা’র সময় বঙ্গদেশকে আরও ১৫ টি সরকারে ভাগ করে ৬৬৮টি পরগনা বিভক্ত করা হয়। এরমধ্যে বাহারবন্দ পরগণা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশাসনিক এলাকা। এর কাছাকাছি আরো একটি পরগনা ছিল, ভিতরবন্দ পরগনা। বাহারবন্দ ও ভিতরবন্দ পরগনা নিয়ে সরকার বাঙ্গালাভূম গঠিত হয়েছিল। ৮৪টি মৌজা নিয়ে বাহারবন্দ পরগনা। ২৮টি তরফ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা হতো উলিপুর তথা বাহারবন্দ পরগনার সদর দপ্তর থেকে।
তৎকালীন সময়ে ফসলি জমির রাজস্ব আদায়ের একটা তালিকা লেখক দিয়েছেন—
বাহারবন্দ পরগণায় প্রচলিত ভূমি রাজস্ব ছিল কিছুটা এরকম- এক ফসলি ধানের জমির জন্য প্রতি বিঘায় রাজস্ব দিতে হতো ১ টাকা থেকে ১.৪ টাকা। দুই ফসলি ধানের জমির জন্য রাজস্ব ছিল বিঘায় ১.৮ টাকা। এছাড়া খেসারি ডালের জন্য বিঘা প্রতি রাজস্ব ছিল ১.৮ টাকা। পাটের জন্য রাজস্ব ছিল বিঘা প্রতি ১ টাকা থেকে ১.৮ টাকা। তামাক চাষের জন্য প্রতি বিঘায় ১ টাকা থেকে ১.৮ টাকা রাজস্ব প্রদান করতে হতো। এছাড়া আখ চাষের জন্য রাজস্ব ছিল ১.৮ টাকা থেকে ২ টাকা পর্যন্ত বিঘা প্রতি। সুপারির জন্য ২ থেকে ৩ টাকা প্রতি বিঘা। পান চাষের জন্য ৩-৪ টাকা প্রতি বিঘায় রাজস্ব প্রদান করতে হতো। সরিষার জন্য রাজস্ব ছিল ১ থেকে ১.৮ টাকা প্রতি বিঘা। পিঁয়াজের জন্য বিঘা প্রতি রাজস্ব ছিল এক টাকা। এছাড়া বেগুন চাষে বিঘা প্রতি ১.৮ টাকা রাজস্ব প্রদান করতে হতো।
এই রাজস্ব আদায়ের চাষ যারা কাজ করতো বা জমিদারের কর্মচারীর দায়িত্ব পালন করতো তাদের নির্দিষ্ট একটা নামে ডাকা হতো যেমন— মৌজা বা তালুকপ্রধানের পদবী ছিল বসুনিয়া, যারা রাজস্ব সংক্রান্ত হিসাব সংরক্ষণ করতেন বা গ্রাম পর্যায়ের হিসাব রক্ষক তাদেরকে পাটোয়ারী বলা হতো, যারা গ্রামের মোড়ল গিরি করত বা ক্ষমতাসীন তাদের পদবী মন্ডল, যারা আইনগত প্রমাণ বা সাক্ষী হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করেন তাদের পদবী প্রামানিক, জমিদারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তিনি কাজ করতেন তার পদবী গোমস্তা, অর্থ প্রতিনিধির পদবী নায়েব, ডেপুটি নায়েব হিসেবে কাজ করতেন তহশীলদার, যিনি জমিদারি তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করতেন তার পদবি পোদ্দার, যে প্রজাদের খাজনা জমার প্রস্তাব রাখেন তিনি জমানবিস, এবং যিনি সীমারেখা নির্ধারণ করেন তিনি আমিন —এরকম অনেক পদবী পাওয়া যায়।
★ উক্ত প্রসঙ্গের সাংঘর্ষিক বিষয়বস্তু:
উলিপুরের আঞ্চলিক গবেষক আবু হেনা মুস্তফা রচিত ‘উলিপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থের ৫৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ওয়ারেন হেস্টিংয়ের জীবন বাঁচানোর জন্য কৃষ্ণকান্ত নন্দীকে রানী ভবানীর কাছ থেকে পুরস্কার স্বরূপ বাহারবন্দ পরগনা দেওয়া হয়েছিল, এই বিষয়টি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন। তিনি নিয়ম মেনেই, রানী ভবানীর নিকট থেকে বাৎসরিক ৩ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা রাজস্বের বিনিময়ে বাহারবন্দ পরগণা নিয়েছিলেন। মো. মঈনুল হাসানের বক্তব্যে ‘জোর’ শব্দটির প্রয়োগ এক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। প্রত্যাশা করি, ইতিহাসবেত্তাগণ এর যথাযথ তথ্য অনুসন্ধান করে উপযুক্ত সত্য ঘটনাটি উদঘাটন করবেন।
★ একটি ভ্রান্ত ধারণা:
মহারানী স্বর্ণময়ীর যে ছবিটি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে তা একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। মহারানীর সমস্ত ছবি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বইয়ে যে ছবিটি স্বর্ণময়ী নাম করে ছাপানো হয়েছে সেটি মূলত কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর ছবি। উনি মূলত সাহিত্যিক ছিলেন। লেখকের উচিত ছিল, প্রত্যেকটি ছবির নিচে সংগ্রাহকের বা তথ্যসূত্র যুক্ত করা। এটি মহারাণী স্বর্ণময়ীর ছবি নয় তার প্রমাণ হিসেবে স্বর্ণকুমারী দেবীর রচিত প্রিন্ট পোয়েট্রি প্রকাশনীর ‘গান ও কবিতা’ বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো ছবির কথা বলে যেতে পারে এবং অন্যান্য অন্তর্জাল এবং জাতীয় পত্রিকায় ছাপানো ছবিগুলোর সূত্র উল্লেখ করা যেতে পারে।
ছবিটির প্রামাণ্যতা বিষয়ক কয়েকটি সূত্র:
১. আর্কাইভ
২. দৈনিক জনকণ্ঠ
৩. ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি
৪. কালবেলা
৫. কলকাতা ৩৬১
★ উপসংহার:
ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে ইতিহাস অনুসন্ধানী মানুষেরা একের পর এক নথিপত্র সংগ্রহ করে নানানভাবে ইতিহাসকে আগলে রেখেছেন। যারা জানতে চান, জানার জন্য ছোটেন, তাদের জন্য মো. মঈনুল হাসানের উৎকৃষ্ট ফসল ‘বাহারবন্দ পরগণা ও মহারাণী স্বর্ণময়ী’ বইটি। বইটিতে বাহারবন্দ পরগণার আদ্যোপ্রান্ত আলোচনা করা হয়েছে এবং মহারাণী স্বর্ণময়ীর জীবনের ট্রাজেডিকে অনুপম রচনায় গড়ে তুলেছেন। বইয়ের প্রচ্ছদ ইতিহাসকে ধারণ করে— দারুণ অনুভূতি জাগ্রত করে। বইটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ সাবলীল ভাষায় চমৎকার প্রকাশ পেয়েছে— নতুন পাঠকের জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিয়েছে বইটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ। আশাকরি, ‘বাহারবন্দ পরগণা ও মহারাণী স্বর্ণময়ী’র সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানতে মো. মঈনুল হাসানের বইটি পাঠকবর্গকে অনুপ্রাণিত করবে।
★★★★★★★★★★
বাহারবন্দ পরগণার ইতিহাস ও মহারাণী স্বর্ণময়ী
মো. মঈনুল হাসান
প্রকাশনী: আইডিয়া প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
পৃষ্ঠা: ১৫৬
দাম : ৪০০ টাকা।
ISBN : 978-984-97208-7-4
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম