পার্ল এস বাক এর অমর উপন্যাস ‌‌'গুড আর্থ' এর আলোচনা - রিপনার্য কর্মকার

পার্ল এস বাক এর অমর উপন্যাস ‌‌'গুড আর্থ' এর আলোচনা - রিপনার্য কর্মকার

উপন্যাসের শুরুটা উপন্যাসের মূল চরিত্র ওয়াঙ লাঙের বিয়ে নিয়ে। ওয়াঙ লাঙ একজন অতি দরিদ্র চাষী। রাজদরবারের কোন এক অসুন্দরী দাসীর সাথে তার বিয়ে। আর এ বিয়ের কথা ভেবে তার ভেতর-বাহিরের যে পরিবর্তন, তা কথাসাহিত্যের যাদুকর পার্ল এস বাক্ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। এরপরওয়াঙ তার হবু বউকে নিতে জমিদার বাড়ি যায়। জমিদার বাড়ির ফটকের দারোয়ান একটি মূদ্রা নিয়ে তবেই তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। এ যেন বিশ্বচরাচর প্রক্রিয়া। কালের আবর্তে এই কু-অভ্যাস আজও রমরমাভাবে চলছে। যাহোক, দারোয়ানের তাচ্ছিল্যসূচক ব্যবহার, বেগম সাহেবার অবহেলা উপেক্ষা করে ওয়াঙ দাসী ওলান নান্নীকে নিয়ে বাড়ি আসে। অতঃপর শুরু করে সংসার জীবন।

ওলান অসুন্দর হলেও তার শান্ত ও পরিশ্রমী স্বভাব ওয়াঙকে আকৃষ্ট করে। তারা একে অপরকে আপন করে নেয়, যেমন করে একটি অগোছালো পাখি অন্য একটি হাঘরে পাখিকে আপন করে নেয়। এখন আর ওয়াঙকে রান্না করতে হয় না। তার বুড়ো বাবাকে পানি গরম করে দিতে হয় না। সব ওলান নিজ হাতে করে। আবার ফসলের ক্ষেতেও পরিশ্রম করে ওলান।

এভাবে চলতে থাকে তাদের জীবন। হঠাৎ একদিন ধানক্ষেতে ওলান বলে 'আমার সন্তান হবে’। ওয়াঙ এ কথা শুনেও এমন ভান করে যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু ভেতরে তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অবশেষে আবেগমাখা কন্ঠে বলে ওঠে-

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এবার এসো বাড়ি যাই। বাবাকে খবরটা দিতে হবে।


ওয়াঙ বাবাকে বলতেই তার বাবা হো হো করে হেসে বলে,

তাহলে ফসল তোলার মৌসুম আসলো!


প্রবহমান নদী যেমন আপন গতিতে কুলকুল শব্দে বয়ে চলে, উপন্যাসিক এখানে কাহিনিকে গতি রেখে ধীরে ধীরে পাঠককে গল্পের ভেতওে প্রবেশ করাচ্ছেন।

এরপর আসে ওলানের সন্তান প্রসবের দিন। ওলান ঘরে একা। দ্বিতীয় কোন নারী নেই তাকে সাহায্য করার। একটি বাঁশের কঞ্চি চেঁছে আগেই ধারালো করে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যা নামলো। ভেতরে ওলান হিংস্র জন্তুর মত গোঙ্গাচ্ছে। ওদিকে টাটকা রক্তের ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাড়ি। কন্ঠটি ধীরে ধীরে চাপা কাতরানোতে পরিনত হলো। এটি মূলত ওয়াঙ এর প্রসব যন্ত্রণার গোঙ্গানীর শব্দ। হঠাৎ একটা তীব্র কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। আর ভেতর থেকে ওলানের অস্পষ্ট কন্ঠ শোনা যায়-

ছেলে।


ওয়াঙ আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে ওঠে-

এক ঝুড়ি ডিম কিনে এনে লাল রং করে গাঁয়ের লোকদের বিলিয়ে দিতে হবে। সবাই জানবে আমার ছেলে হয়েছে।


পরের দিন থেকে ওয়াঙ আবার কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন। ওলানও কিছুদিন পর যোগ দেন। তারপর আসে গম রোপনের মৌসুম। একটি একটি করে শস্যদানা তাদের সংসারের সমৃদ্ধি বাড়াতে থাকে। একে একে তাদের সন্তানের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং একটু একটু করে তারা জমিদারের জমি ক্রয় করতে থাকে।

কিন্তু ভালো দিন উপন্যাসিকের লিখতে যেন বড্ড কষ্ট হয়। তাদের সুখের সংসারে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা কড়া নাড়ে। দীর্ঘদিন বৃষ্টির দেখা না থাকাই ফসল লাগাতে পারে না গ্রামের সকল কৃষক। এক পর্যায়ে খাবারের অভাবে দুর্ভীক্ষ দেখা দেয়। ওয়াঙের চাচা দুঃসময়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। খাবারের জন্য ওয়াঙের বাড়িতে গ্রামের মানুষদের ভুলিয়ে ডাকাতি দেয়। কিন্তু তারা কিছুই পায় না। কারণ তাদের সঞ্চয় অনেক আগেই শেষ। এমতাবস্তায় ক্ষুধায় মৃতপ্রায় ওয়াঙ পরিবার দক্ষিণদেশে যেখানে নগর গড়ে উঠেছে, আছে খাবারের সুব্যবস্থা, সেখানে যেতে চায়।

কালই তারা রওনা হতে চায়। কিন্তু বিপদ বড়ই চতুর। সে একা আসে নাই। রাতে ওলানের চতুর্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য প্রসব বেদনা ওঠে। এই দুর্ভিক্ষের দিনে নতুন মুখ। ওয়াঙ বাহিরে বিড়বিড় করে যেন মৃত সন্তান হলেই রক্ষা হয়। সেই সময় একটি ক্ষীণ কান্নার আওয়াজ ভেসে এসে আবার বাতাসে মিলিয়ে যায়। পরে ওলান জানায়, তার মৃত সন্তান হয়েছে। ওয়াঙ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দেখে একটি মেয়ে সন্তান।

ওয়াঙ কাছেই একটি কবরের গর্তে তার শেষ ক্রিয়া করতে চায়। কারণ বেশি দুরে যাওয়ার মত শক্তিটুকুও তার শরীরে নেই। সে দেখে বাচ্চার গলায় দুটো থেতলানো দাগ। বিষয় বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু  ওলানকে কিছু বলার সাহস আজ তার নেই।

পরের দিন সকালে তারা যাত্রা শুরু করে দক্ষিণদেশে। বহু কষ্টে সেখানে পৌছে সপরিবারে ভিক্ষা করে জীবন-যাপন শুরু করে। পরে অবশ্য ওয়াঙ রিক্সা চালানো শুরু করে। এখানে তাদের জীবন ভালোয় চলতে থাকে, খাবারের অভাব নেই, নেই কোন বৃষ্টির জন্য দিন গোনা। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় পরও তাদের কোন উন্নতি হয় না। এটাই শহরের সিস্টেম। গরীবরা চিরকাল গরীব, আর ধনীরা আরও ধনী। এদিকে তার ছেলে ভিক্ষা করতে করতে চুরি করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে গ্রামে তার জমির টান, মাটির মায়া তাকে কাছে টানে।
 
এরই মধ্যে শহরে বসন্তের বাতাস বইতে শুরু করে। পুঁজিবাদী সমাজে বিত্তবানদে বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দেয়। দ্রুত ছড়িয়ে পরে পুরো শহরজুড়ে। বিদ্রোহীরা ধনীদের বাড়িঘর লুট করতে থাকে। ওয়াঙের বস্তির পিছনের মস্তবড় দেওয়ালের মাঝখানের ফটকটি ভেঙ্গে মানুষ ঢুকে পড়ে। ওয়াঙ ও তার স্ত্রী সেই বাড়ি থেকে প্রচুর মোহর, হিরে-জহরত হস্তগত করে। এরপর আর এক মুহূর্ত দেরি না করে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করে।

গ্রামে এসে ওয়াঙ হালের বলদ কিনে; কিছু বীজও কিনে কাছের বাজার থেকে। আবার শুরু করে চাষের কাজ। এদিকে জমিদারের কাছ থেকে তার সেই মোহর আর মনিমুক্ত দিয়ে কিনতে থাকে আরও অনেক জমি। এবার তার ফসলও হয় অনেক। নিজের জন্য রেখে বাকি সব বিক্রয় করে তা দিয়ে জমি কিনতে থাকে। এভাবে মৌসুম আসে আর ওয়াঙের লাঙলে জমির পরিমাণ ফুলে ফেঁপে উঠে। এক সময় ওয়াঙ জমিদারের প্রায় সকল জমি কিনে ফেলেন। গ্রাম থেকে গ্রামে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। লোকমুখে বলাবলি করে ওয়াঙ চাষী জমিদারি কিনে নিয়েছে। এদিকে তার মনে বহু দিনের বাসনা শহরের আলোকসজ্জায় সজ্জিত হটেলের ভেতরে যাবে। সেখানে কী নেই। ভালো খাবার, জুয়ার বোর্ড, মেয়ে আর! একদিন সে ভেতরে প্রবেশ করে আর তার ভেতরের সয়তানটা গোলকধাঁধাঁয় আটকে যায়। এক সুন্দরী নারীর কাছে তার নিয়মিত যাতয়াত শুরু হয়। এক পর্যায়ে সে মেয়েটিকে বাড়িতে রক্ষিতার মত রাখে। আর তার দেখাশোনার জন্য আরও একজন দাসীকে রেখে দেয়। ওলান এসব না বোঝার আর কিছুই থাকে না। কিন্তু প্রকৃতি বড়ই নিষ্ঠুর আর বৈরী। ওলান আজ অসহায়।
 
কাহিনি আরও করুণ পরিণতির দিকে মোড় নেয়। ওলনের বুকে বাসা বাঁধে মৃত্যুব্যাধি। আসলে তার বুকের পুরানো ব্যাথ্যাটা সুযোগ বুঝে তার মুত্যুর দূত হয়ে সামনে দাঁড়ায়। ওলান শয্যাগত হয়ে পড়ে। এক সময় এ শূন্য পরিবারে সে পরিশ্রম দিয়ে, সন্তান দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলো। মৃত বাগানটাকে সে যেন প্রাণ দান করে। কিন্তু সেই সাজানো বাগানে আজ তার গুরুত্ব বড্ড কম। যদিও ওয়াঙ চাষী শহরের সবচেয়ে বড় ডাক্তারকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে তার চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা করে। কিন্তু তা আর তেমন কাজে লাগে না। কোন এক দিবসে এক পাহাড় ব্যাথা নিয়ে পাড়ি জমায় নিরুদেশ যাত্রায়।
 
ওয়াঙ চাষী ধীরে ধীরে আরও বুড়ো হতে থাকে। সে জমিদার বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনী নিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করে। অঢেল সম্পদের দরুন দিন দিন দাস-দাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে সম্পদের পরিমাণও। এত সম্পদ যে, আগামীর কয়েক পুরুষ বসে বসে খেলেও সে সম্পদ শেষ হবে না।

শেষ বয়সে মাঠে তেমন যেত না ওয়াঙ। দেখাশোনার জন্য অনেক লোক রয়েছে। ছেলেওরা যার যার মত দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। একদিন ওয়াঙ মাঠে যায়। সে কি যেন দেখে। আসলে সে তার চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার জন্য জায়গা নির্বাচন করে। কফিনও বানিয়ে রেখেছে আগেই। তার আর কোন চিন্তা নেই। এদিকে ছেলেরা চায়, কিছু জমি বিক্রয় করতে। ওয়াঙ একথা শুনলেই রেগে যান। তবে, ওয়াঙের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জমি বেচার জন্য একটি রোল পড়ে যাবে, তা পাঠকের বুঝতে আর সমস্যা হওয়ার কথা না। আর এভাবেই নোবেল জয়ী উপন্যাসিক তার উপন্যাসের ইতি টেনেছেন। এ যেন শেষ হয়েও শুরু হলো আবার নতুন করে। পাঠক মনে চলতে থাকবে এর রেশ আরও বহুদুর।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ