বছরখানেক আগে এক অগ্রজ লেখকের ফেসবুক পোস্টে প্রথম চোখে পড়ল বইটির নাম—‘টিয়াদুর’। নামটি এত অদ্ভুত ও কৌতূহল জাগানো যে, তখনই মনে হলো, এটা হয়তো কোনো লাতিন আমেরিকান লেখকের লেখা। সেই প্রথম ধারণাটাই ছিল ভুল। রাজশাহী থেকে কুরিয়ারে যখন বইটি হাতে এল, তখন ভেতরের পৃষ্ঠা খুলতেই দেখলাম—বড় বড় অক্ষরে লেখা, যেন পুঁথির বই। ছাপার মান দেখে মনে হলো, মফস্বল শহরের কোনো প্রেসে ছাপা। প্রকাশকের নাম দেখে প্রথমে হাসি পেল—‘পেঁচা সম্পাদনা পর্ষদের পক্ষ থেকে শারিক স্মৃতি, শিরাইল মোল্লা মিলের গলি, রাজশাহী।’ এমন নাম রাখার পেছনে নিঃসন্দেহে রসিকতা ছিল।
লেখকের নামও কম চমকপ্রদ নয়। তিনি প্রকাশিত হন ‘ইচক দুয়েন্দে’ নামে, যদিও জানা গেল, এটি তাঁর প্রকৃত নাম নয়। প্রথমে ভেবেছিলাম, এই নাম এবং বইয়ের শিরোনাম নিছক মজার জন্যই তৈরি। কিন্তু বইটি পড়তে শুরু করার পরই সমস্ত ধারণা উলটে গেল।
জাদুবাস্তবতার ছায়ায় এক রাজনৈতিক রূপকথা
‘টিয়াদুর’ পড়তে গিয়ে প্রথমে মনে হবে, আপনি হয়তো কোনো অচেনা কল্পকাহিনীর রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। এখানে নেই কোনো নির্দিষ্ট দেশের নাম, নেই কোনো সময়ের উল্লেখ। এটি যে কোনো দেশ হতে পারে—রূপকথার কোনো আধুনিক রাজ্যও হতে পারে। তবে, সময়ের ছাপ স্পষ্ট। হেলিকপ্টার, ট্যাংক, জাতীয় সংসদ, কমান্ডো, ঝটিকা বাহিনী—এসব আধুনিক শব্দে ঠাসা। আর সব চরিত্রের নাম যেন আদিবাসীদের। তাদের জনপদ, যানবাহন (যেমন ‘অজগর যান’) সব কিছুই যেন বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করে এক কল্পনার জগৎ তৈরি করেছে।
ইচক দুয়েন্দে এক অদ্ভুত দক্ষতায় এক জটিল রাজনৈতিক কাহিনি বলে গেছেন সরল বাংলায়। তাঁর ভাষা রসালো, সংলাপগুলো কবিতার মতো। এখানে আছে প্রেম, আছে বিদ্রোহ, আছে মিথ, আর আছে এমন এক রাজনৈতিক সংকটের রূপক, যা আমাদের বাস্তবতার চেয়ে আরও গভীরে গিয়ে প্রশ্ন তোলে।
‘টিয়াদুর’ পড়তে গিয়ে বারবার মনে পড়ে আমোস টুটুওয়ালার জাদুবাস্তব কাহিনি, কিংবা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ঘোরলাগা মাকোন্দ গ্রামের জাদুবাস্তবতা। তবু, ইচক দুয়েন্দে তাঁদের সামান্য পাশ কাটিয়ে আরেকটু নতুন ধাচে সৃষ্টি করেছেন। এমন রূপকধর্মী উপন্যাস জর্জ অরওয়েলও হয়তো কল্পনা করেননি।
বইয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর রূপকের গভীরতা। কোনো চরিত্র, কোনো ঘটনা বা স্থান এখানে স্রেফ সরল বর্ণনা নয়। প্রতিটি নাম, প্রতিটি সংলাপ, এমনকি পরিবেশের বর্ণনাতেও প্রতীকী অর্থ লুকিয়ে আছে। লেখকের সূক্ষ্ম দক্ষতায়, এই প্রতীকগুলো কখনো প্রশ্ন তোলে, কখনো কৌতূহলী করে তোলে, আবার কখনো ভেতরে এক নিঃশব্দ বিদ্রোহ জাগিয়ে তোলে।
প্রথম অধ্যায় ‘তরুমা চি’-এর প্রথম লাইনগুলোই এই বইয়ের অদ্ভুতুড়ে জাদুকে ধরে রাখে:
আনন্দ। তাহতি দুর্দিক আসার পর থেকে ঝিমকাননে বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। দুর্দিকচিরমা আড্ডায় মশগুল। ‘ঈল্লিচিল্লি চৌদ্দভূজ’ বহুকাল পর আনন্দে নাচে। তারপর সেই দিনটিতে রোদ ওঠে। এমনই পাগলপারা রোদ যে ঘরকে বাহির ডেকে নেয়।
এই সূচনা যেন এক অদ্ভুত জগতে প্রবেশের আমন্ত্রণ। প্রতিটি লাইন যেন আলাদা করে ব্যাখ্যা দাবি করে, তবু পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই জগতে, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনার সীমা মুছে গেছে।
ত্রুটির মাঝে বিস্ময়কর সৃষ্টি
এই বইয়ের একমাত্র ত্রুটি এর অসংখ্য চরিত্র ও ঘটনাপ্রবাহ, যা মনে রাখা কঠিন। তবে, এটিই হয়তো ইচক দুয়েন্দের পরিকল্পনা। তিনি পাঠককে শুধু কাহিনি পড়তে বলেন না; বরং একটা জগৎ তৈরি করে সেই জগতে প্রবেশ করান।
২০১৬ সালে প্রথম প্রকাশিত এই বইটি আসলে এক অনন্য শিল্পকর্ম, যা বাংলা সাহিত্যের প্রান্তিক জগৎ থেকে উঠে এসে আমাদের বিস্মিত করেছে। এটি একাধারে জাদুবাস্তব, রূপকথা, কবিতা এবং বিদ্রোহের এক মায়াবি উপাখ্যান।
**********
টিয়াদুর
ইচক দুয়েন্দে
প্রকাশক: পেঁচা, রাজশাহী
প্রকাশকাল: ২০১৬
পৃষ্ঠা: ৩৪৯
মূল্য: ৭৫০/-
ISBN: 9789843515551
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম