ইচক দুয়েন্দে লিখিত 'উই আর নট লাভারস্' উপন্যাসের আলোচনা - কবি আশরাফুল কবীর

ইচক দুয়েন্দে লিখিত 'উই আর নট লাভার্স' উপন্যাসের প্রচ্ছদ
 


Reading maketh a full man; conference a ready man; and writing an exact man." Francis Bacon, English Philosopher and Statesman.


ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের এ (প্রথমাংশের) মতানুসারে পঠন একজন মানুষকে সম্পূর্ণ করে বা সম্পূর্ণ হওয়ার বৃত্তটাকে আসলে পূর্ণ করে। একটি বই শেষ পর্যন্ত পড়ে যেতে হবে কি হবে না, তা আসলে নির্ভর করে বইটির ধারা, রীতি, বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, উপস্থাপনা, পাঠকের রুচি, ধৈর্যসহ অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর।

একটি ভালো বই হচ্ছে অনেকগুলো সুতীব্র ও প্রমথিত ভাবনাসমূহকে উসকে দেয়ার একটি উপক্রমণিকা মাত্র। একটি ভালো বই পাঠের আনন্দ বুঝিয়ে বলা কিংবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যাওয়া নেহায়েত দুরূহ ব্যাপার। এটা বলা যায় যে, একটি ভালো বই মুহূর্তের মধ্যে মনকে চাঙ্গা করে তোলার কিংবা দৃশ্যপট পরিবর্তন করার সমস্ত রশদ-উপকরণই অত্যন্ত সরসভাবে সরবরাহ করে, আর শুধুমাত্র রশদ সরবরাহ করেই বইয়ের মৌলিক এ কাজটি ফুরোয় না, কিংবা সম্পন্ন হয় না, হয় না ক্ষয়িষ্ণুও; বরঞ্চ আলকুশির মতো বইয়ের কাহিনি পাঠকের অবচেতন মনকে প্যাঁচিয়ে ফেলে, ক্রমাগত তাড়া করতে থাকে সামনের দিকে। এ সন্ধিক্ষণে বইয়ের চিত্রপটও পথ দেখিয়ে পাঠককে নিয়ে চলে দূর-দূরান্তরে। পাঠক নতুন সব ভাবনায় তাড়িত হয়, অনিবার্যভাবে পাঠক অজানা এ সফরে সব ভুলে বইয়ে হয়ে ওঠে বিভোর ও পাঁড়মাতাল।

ঠিক তেমনি একটি চমৎকার উপন্যাসের নাম উই আর নট লাভারস্ (We Are Not Lovers)। উই আর নট লাভারস্ একটি দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর উপন্যাস। চতুর্ভুজাকার/(চারজনের মধ্যকার) ভালোবাসার গল্পকে আবদ্ধ করে এ উপন্যাস সম্মুখে এগিয়েছে যার ভিত্তিভূমি বাংলাদেশের গঙ্গাঋদ্ধি (গঙ্গারিডাই) অঞ্চল।

ভালোবাসাকে উপজীব্য করে রচিত এ উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলো হল - নিভিয়া অরিন্দুয়েলা (Nivia Orinduela), দুনিয়া তিন্তি (Dunia Tinti) ও মাইকেল অ্যাঞ্জেলো (Michael Angelo) সাথে পার্শ্বচরিত্র হিসেবে কিয়ৎ পেত্রোসিয়া চিনচিনি (Petrocia Cincini)। গঙ্গাঋদ্ধি শহরে সান ফ্র্যান্সিসকো থেকে বেড়াতে আসা মার্কিন পর্যটক মাইকেল অ্যাঞ্জেলো ও স্প্যানিশ নিভিয়া অরিন্দুয়েলার মধ্যকার আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের শুরু। সময়কাল আগস্ট ২০০২।

কথা প্রসঙ্গে ও ঘটনার পরম্পরায় মাইকেল নিভিয়া অরিন্দুয়েলার মুখে তার প্রেমিক দুনিয়া তিন্তির নাম জানতে পারে -

'Is Dunia Tinti your lover?'
'He is my soul,' replied Nivia.
'Your love is so great and intense,' said Michael.
'You know a very little of the world, Michael. If you really want to see a great love, follow me, but don't talk much, just follow me and watch.



পুরো উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহে মাইকেলকে নিভিয়ার কথামতো নিভিয়াকে ও নিভিয়ার কার্যক্রমকে অনুসরণ করতে হয়, এর কোনো ভিন্নতা হয় না, সাথে পাঠককেও। এ সকল ঘটনাসমূহের মধ্যে ধীরেধীরে আবির্ভূত হয় অদ্ভুত নামের সব চরিত্রসমূহ ও স্থান এবং অদ্ভুত শব্দগুচ্ছের প্রদর্শনীঃ 


Mr. Ki Buzhlen (রিকশাওয়ালা), BihbaBaba (পবিত্র স্থান), Bikum ও Taina (প্রেমিক-প্রেমিকা), Mr. Dik Pakow (স্থানীয় কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক), Hampoo Merpoo (স্থানীয় ক্যাডার বাহিনীর প্রধান), Puchipucha Chikichuta (দুনিয়া তিন্তিকে গালি দিতে গিয়ে নিভিয়ার ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ), Haung ha goskata (নিভিয়াকে হুমকি দিতে ডিক প্যাকোর ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ), Nia nia qui qui (মাইকেলের আওড়ানো ইচ্ছা পূরণের লাতিন মন্ত্র), Chia pia khea khea hui hui, Nia nia hai hai jeana jeana pun pun muki baow (নিভিয়ার উচ্চারিত মন্ত্র), Hales Waugunipai (নিভিয়ার ছোট ভাইয়ের  নাম), Zibrazagoonta (মাইকেলকে বোকা বলতে গিয়ে নিভিয়ার ব্যবহৃত শব্দ), Goka Gopak Vurulunthon (রাশিয়ান নাচবিশেষ) ইত্যাদি।


উপন্যাসটির শুরুর দিকে নিভিয়া অরিন্দুয়েলা ও দুনিয়া তিন্তির মধ্যকার পাঠানো ইমেইলগুলো (পৃষ্ঠা ১৩ ও ৬৭) পাঠপূর্বক দুজনের মধ্যকার ভালোবাসা 'ইলেকট্রা কমপ্লেক্স' বলে পাঠকের ভ্রম হতে পারে, তবে পুরো থ্রিলারটি পাঠের পরে এ ধারনার সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। পুরো উপন্যাসে ঘটে চলা কনশাস ও সাব-কনশাস পরিস্থিতির মধ্যে নিভিয়ার বৈশিষ্ট্যের (লেখকের ভাষায় a young girl of her early twenties) কিছুটা ছোঁয়া পাওয়া যায় পেত্রোসিয়ার নিম্নোক্ত বর্ণনায়ঃ

One thing I wanted to tell you for a long. It's a problem you can't bear any negative opinion about Nivia. But you know how much I like her. She is my very good friend. But today I want to tell you, what I really feel about her. She is mad! I think she has been suffering from a very complicated mental disease. She needs to be treated properly. She needs appropriate counselling,' Petrocia said. (পৃষ্ঠা ১২৫)



মাইকেলের সাথে নিভিয়ার সম্পর্কে ব্যাপারে লেখক একদিকে যেভাবে দুনিয়া তিন্তির মাধ্যমে সতর্কবার্তা দিয়েছেন ঠিক একইভাবে পেত্রোসিয়ার সাথে দুনিয়ার সম্পর্কের ব্যাপারেও নিভিয়ার ইবার্তার মাধ্যমে তার রাগের বহিঃপ্রকাশ করেছেন। ফলশ্রুতিতে সম্পর্কের এ বাঁক বদল ক্ষণে ক্ষণে পাঠককে দারুনভাবে পরীক্ষায় ফেলে। নিভিয়ার সাদা বিয়ের পোশাকের রহস্যভেদের জন্য পাঠককে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।


চমৎকার ও দুর্দান্ত এ থ্রিলারটি পাঠপূর্বক লেখক ইচক দুয়েন্দে'র (Ichok Duende) লেখার ভঙ্গি, কালের সংশ্লেষ, সহজ-সরল পরিবেশনা, সচেতন ও অর্ধচেতন অবস্থার মিথস্ক্রিয়া, কাহিনির অগ্রগতি সর্বোপরি লেখার সাবলীলতা লেখার প্রতি তাঁর দীর্ঘ প্রস্তুতি, দক্ষতা ও কুশলতার চমৎকার পরিচয় পাওয়া যায়। কানের সন্নিকটে যেন উচ্চারিত হতে থাকে - 'Nia nia qui qui। পরিশেষে পুরো বইটি পাঠপূর্বক বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা স্বল্প বৃত্তান্তের সাথে পাঠকের সুরও যেন একীভূত হয়, পাঠক অভিভূত হয়, অভিভূত হতে বাধ্য হয়ঃ

We are not lovers is reminiscenses of olden times when love was said to be sacred.


উই আর নট লাভারস প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ সালে। বইটি প্রকাশ করেছেন মুহম্মদ শামসুল কবীর (ইচক দুয়েন্দে), কাভার ছবিঃ Shimul Salahuddin, বইটির মূল্যঃ চারশত পঞ্চাশ টাকা।

চমৎকার এ উপন্যাসের জন্য লেখককে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।


**********
উই আর নট লাভারস
ইচক দুয়েন্দে


প্রকাশক: পেঁচা, রাজশাহী
প্রকাশকাল: ২০২৩

পৃষ্ঠা: ২০৫
মূল্য: ৪৫০/-
ISBN : 9789843547729

**********
প্রথম প্রকাশ: বুনোহাঁস

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ