এমন অনেক জাতি আছে, যারা অনেক অনেক বছর হলো যুদ্ধ কাকে বলে জানে না। তাদের শহরের ওপর বোমারু বিমান হানা দেয়নি, ট্রাংকের ক্যাটারপিলার তাদের খেতের শস্য মাড়াইনি। নীরব ডাকপিয়নকে নিকট আত্মীয়স্বজন নিহত হওয়ার সংবাদ নিয়ে তাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দরজায় ঘা দিয়ে বেড়াতে হয়নি। সেই সব জাতি যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে বই পড়ে, সিনেমা দেখে, বৃদ্ধদের মুখে গল্প শুনে।
যুদ্ধ যারা জানে না, এ বই পড়ে তারা অবাক হতে পারে। একটা সাধারণ ছেলে, যার ছোেটা উচিত স্কুলে, যার উচিত পড়াশোনা করা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করা-সে কিনা যুদ্ধের আবর্তের মধ্যে পড়ে গেল, সৈনিকের মৃত্যু বরণ করল!-এ ঘটনা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে।
কিন্তু এই বইয়ের নায়ক সম্পর্কে, খাঁটি রুশ নামধারী একটি ছেলে ইভান সম্পর্কে তোমরা যা যা জানতে পারবে, সে সবই সত্যি।
আমি বলব তার চেয়েও বেশি। এই কাহিনি এক বিরাট নিষ্ঠার সত্যের একটি অংশ, যাকে বলে যুদ্ধে শিশুদের ভূমিকা, সেই আশ্চর্য বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের একটি পাতা।
সকলে জানে যে যুদ্ধ পুরুষের কাজ, বয়স্ক লোকদেরই তা সাজে। হয়তো কোনো এক কালে সুদূর অতীতে তা-ই ছিল। কিন্তু আধুনিক কালের যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদারদের যুদ্ধ ক্ষমাহীন। এই যুদ্ধে আবালবৃদ্ধবনিতা কাউকে রেহাই দেয় না। এ সমস্ত যুদ্ধে দখলদারেরা নিছক সৈন্য নয়, তারা খুনে সৈন্য।
ঠিক এই রকমই এক যুদ্ধ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট জার্মানির যুদ্ধ-মানুষের ইতিহাসে চরম নৃশংস, চরম বিধ্বংসী সে যুদ্ধ।
২১ জুন গভীর রাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্রেস্ত স্টেশন থেকে জার্মানির উদ্দেশে ছাড়ল মালগাড়ি। মালগাড়ির ওয়াগনগুলোর গায়ে খড়িমাটি দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা ছিল সংক্ষিপ্ত, দরদভরা একটি কথা-শস্য। আমরা পশ্চিমে পাঠাচ্ছিলাম শস্য, আমাদের কাম্য ছিল শান্তি।
কিন্তু এর দুইঘণ্টা বাদে, শস্য নিয়ে যেখানে ট্রেন রওনা দিয়েছে, ওধার থেকে ১৯৪১ সালের ২২ জুন প্রত্যুষে আমাদের ওপর এসে পড়ল ইস্পাত আর আগুনের লাভাস্রোত। ফ্যাসিস্টদের লৌহকঠিন দঙ্গলও পথে যা যা পড়ল, ধ্বংস করতে করতে সীমানা পেরিয়ে চলল। বাড়িঘর ধ্বংস হলো, খেতের ফসল আগুনে পুড়ল। সৈন্যদের পাশাপাশি শিশুরাও নিহত হতে লাগল।
শিশুদের রক্ষা করার জন্য, যুদ্ধের অগ্নিস্রোত যেখানে পৌঁছাতে পারে না, সে রকম কোনো দূরত্বে, ফ্রন্টলাইনের গভীর পশ্চাদ্ভাগে তাদের পাঠিয়ে দেবার জন্য আমাদের লোকেরা অবিশ্বাস্য রকমের প্রয়াস চালাল। সর্বপ্রথম স্থানান্তরিত করা হতে লাগল শিশুদের, তাদের জন্য গাড়ি ও অ্যারোপ্লেনের বন্দোবস্ত করা হলো। কিন্তু বয়স্করা সব শিশুকে রক্ষা করতে পারেন নি।
আমার মনে পড়ে ব্রেস্তের কাছাকাছি জায়গায় বনের ভেতরে একটা ছোট্ট নিঃসঙ্গ কবর। একটা খুঁটির গায়ে তক্তা মেরে তার ওপর লেখা আছে: 'এখানে তানিয়া চিরনিদ্রায় শায়িত'। কে এই তানিয়া? কী করে সে ফ্যাসিস্টদের শিকার হলো? আমাদের এই বইয়ের নায়ক ইভানের মতো সে-ও কি একজন খুদে যোদ্ধা ছিল, নাকি ফ্যাসিস্টরা তাকে মেরে ফেলে স্রেফ এই কারণে যে সে বেঁচে ছিল, তার জন্মস্থান এই ধরিত্রীর বুকে ঘুরে বেড়াত, সূর্যকে দেখে আনন্দ পেত?
বহু সোভিয়েত ছেলেমেয়ে শত্রুব্যূহের পশ্চাদ্ভাগে থেকে বয়স্কদের সঙ্গে মিলে সংগ্রাম করে।
শান্তির সময়তেই তারা পোড় খেয়ে পোক্ত হয়ে উঠছিল। তারা জানত কাকে বলে মাইলের পর মাইল কঠিন পথযাত্রা, কাকে বলে ক্যাম্প ফায়ারের সামনে রাত কাটানো, তারা সহিষ্ণু হতে শেখে, লক্ষ্যভেদী গুলি ছুড়তে, ব্যান্ডেজ বাঁধতে শেখে।
তাদের শিখিয়েছিলেন বয়স্করা, যাঁদের মনে ছিল নবীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্য তাঁদের সংগ্রামের স্মৃতি। তাদের শেখায় স্কুল, শেখায় বইপুঁথি।
সোভিয়েত শিশুদের প্রিয় লেখক আর্কাদি গাইদার কী বলে যুদ্ধের মুখোমুখি হন? শোন:
আমি মরণকে পরোয়া করি না। আমাকে বন্দুক দাও, আমি সঙিন আর গুলি নিয়ে যাব মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে।
এই শিক্ষা আমাদের শিশুদের কাজে লাগে।
যুদ্ধে শিশুদেরও ভূমিকা ছিল। তারা বয়স্কদের বোঝা হয়ে থাকেনি, যদিও কঠিনতম মুহূর্তেও সোভিয়েত লোকেরা শিশুদের দুঃখদু-দশা হালকা করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেনি। শিশুদের মধ্য থেকে বেশ কিছু দৃঢ়চেতা, নির্ভীক যোদ্ধার আবির্ভাব ঘটে।
যুদ্ধের শেষ তোপধ্বনি মিলিয়ে যাবার পর আরও অনেক বছর কেটে গেছে। কিন্তু লোকে এখনো ভলোদিয়া দুবিনিন, গুলিয়া করলিওভা বা জোইয়া কস্মদেমিয়ান্স্কায়ার মতো যোদ্ধাদের কথা ভোলেনি।
এই সমস্ত কিশোর-কিশোরীদের প্রথম সারির একজন ছিল জোইয়া কস্মদেমিয়ান্স্কায়া। তার বয়স তখন ছিল আঠারো। স্কাউটিং-য়ের কাজ করতে গিয়ে সে ফ্যাসিস্টদের হাতে পড়ে। সংযতবাক কোমল এই মেয়েটির প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও শৌর্য ফ্যাসিস্টদের বিস্ময় উদ্রেক করে। জেরার সময় সে নির্বাক থাকে, তার ওপরে নির্যাতন চলা সত্ত্বেও সে তার সঙ্গীদের ধরিয়ে দেয়নি। তারপর তার গায়ের পোশাক খুলে নিয়ে তাকে যখন খালি পায়ে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো সে ক্ষমা প্রার্থনা করল না. মৃত্যুকে সে এমন নিস্পৃহভাবে গ্রহণ করল যে তার নাম পরিণত হলো কিংবদন্তিতে। তার নাম বীরত্বপূর্ণ কীর্তিসাধনের পথে আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়, শত্রুর মনে ত্রাসের সঞ্চার করে।
ভলোদিয়া দুবিনিন যুদ্ধের আগে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল। যুদ্ধের সময় মাটির তলার গুহা প্রকোষ্ঠে গেরিলাদের একটি বাহিনী শত্রুর কাছ থেকে আত্মগোপন করে থাকে। ভলোদিয়া হলো সেই বাহিনীর একজন স্কাউট। ছেলেটি ছিল নির্ভীক, চটপটে। সে এমন সমস্ত ফাঁকফোকরের মধ্যে ঢুকে পড়ত, যেখানে ঢোকা কোনো বয়স্ক লোকের সাধ্য হতো না। গণ প্রতিহিংসা বাহিনীকে সে বিপুল সাহায্য করে। সে-ও নিহত হয়-বীরের মহান মৃত্যু বরণ করে।
যুদ্ধে শিশুদের ভূমিকা সম্পর্কে আরও কথা। সব শিশুই যে হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এমন নয়। অনেকে যার যত দূর সাধ্য, সেই অনুযায়ী বয়স্কদের সাহায্য করেছে।
আমার মনে আছে লেনিনগ্রাদে ছেলেমেয়েদের নিজেদের হাতে গড়া একটা ছোট্ট মিউজিয়ামে আমি স্কুলের এক ছাত্রীর নম্বরের একটা খাতা দেখেছিলাম। সেখানে কেবল ভালো আর উৎকৃষ্ট মানের নম্বর। এরকম নম্বরের খাতা এখন লক্ষ লক্ষ-সেগুলো তো আর মিউজিয়ামে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয় না! কিন্তু ওই খাতাটা ছিল একটা ছোট মেয়ের, যে ১৯৪১-১৯৪২ সালের শীতকালে লেনিনগ্রাদে বসে পড়াশোনা করেছিল।
শহর তখন জ্বলছে, শহরের লোকজন ক্ষুধার তাড়নায়, শীতের কামড়ে মারা যাচ্ছে, অবিরাম বোমা আর গুলিগোলাবর্ষণ তখন শহরের অভ্যস্ত দৃশ্য, শহর শত্রুপক্ষের অবরোধের লৌহবেষ্টনীতে বাঁধা। এই রকম যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও ছোট মেয়েটি করে গেছে তার অভ্যস্ত কাজ-সে পড়াশোনা করেছে। শুধু তা-ই নয়, ভালো নম্বর পেয়ে পড়াশোনা করেছে। এখানেই তার শৌর্য, তার চরিত্রের দৃঢ়তা, আর এই দিয়েই সে প্রতিহত করেছে শত্রুকে, এভাবেই সে সংগ্রাম করেছে।
যুদ্ধে শিশুদের ভূমিকা সম্পর্কে আমি আরও অনেক কথা বলতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয়, এই বইয়ে যে কাহিনিটি তোমরা পড়বে, তার মধ্যে তোমরা তোমাদের সমবয়সী এমন এক ছেলের কীর্তির অকপট, সত্য ও ভয়ংকর বিবরণ পাবে, যে আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে সে প্রাণ দিয়েছে। আর সে প্রাণ বলি দিয়েছে বলেই না নিজের রক্তবন্যার মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে ফ্যাসিবাদের নাভিশ্বাস উঠেছে, তোমার কাছে, আগামী দিনের শিশুদের কাছে আসতে-আসতেও আসতে পারেনি।
খুদে পাঠক, লোকজনের কাছ থেকে আড়ালে, একা একা পড়ার জন্য তোমাদের হাতে আমি তুলে দিচ্ছি চিন্তাভাবনার উপযোগী এই কঠিন বই। মনোযোগ দিয়ে এ বই পড়ো, ছোট্ট রুশ ছেলে ইভানের কাছ থেকে শেখো শৌর্য, সাহসিকতা, আর সবচেয়ে বড় কথা-দেশপ্রেম।
ইউরি ইয়াকভলেভ
~
প্রচ্ছদ: অরুণ সোম অনূদিত, বাতিঘর, ঢাকা থেকে ২০২৩ সালে প্রকাশিত বই থেকে নেয়া
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম