কাইজেন - সারাহ হার্ভে, অনুবাদ: শেহজাদ আমান

কাইজেন - সারাহ হার্ভে, অনুবাদ: শেহজাদ আমান
কাইজেন বইয়ের প্রচ্ছদ


মানুষের জীবন বড় জটিল। অনিশ্চিত সম্ভাবনা নিয়ে মুখোমুখি হতে হয় নতুন সময়ের। এই জীবন কীভাবে পরিচালনা করা উচিত? কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত? দৈনন্দিন জীবন যাপনের পদ্ধতি কী? জীবনের উদ্দেশ্য কী? জীবনবোধ কেমন হওয়া দরকার? আমাদের আচরণ কেমন হলে জীবনের উদ্দেশ্য সাধন হবে -- ইত্যাদি অনেক প্রকারের প্রশ্ন চারপাশে ছড়ানো। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। কোনো কোনো সংস্কৃতিতে মানুষের পাশবিক প্রবনতাকে সামাজিক বন্ধনের উপায় বলে মনে করা হয়। আবার, কোনো কোনো সমাজ মনে করে চঞ্চলতা নয়, জীবনে ধীরতা, স্থিরতা, প্রশান্তির প্রয়োজন। পাশবিক প্রবনতাকে জয় করতে পারার মধ্যে রয়েছে মানব জীবনের সার্থকতা। মানবচর্চিত এইসব বিবিধ মনোভঙ্গির জগতে জাপানের সমাজ চিন্তার অভিনবত্ব প্রকাশ করেছে। তারা শান্ত, ধীর, স্থির, নম্রতা, বিনয়, মগ্নতার পক্ষে। ফলে আমাদের চোখে তাদের চিন্তাজগত ও জীবনাচরণ একেবারে নতুন ও অভিনব।

‘কাইজেন’ জাপানি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ ‘উন্নতি’। 'কাই' মানে পরিবর্তন আর 'জেন' মানে ভাল। ছোট ছোট ধাপে, অল্প অল্প করে, একটু একটু করে ভালোর জন্য পরিবর্তন। জীবন চলার প্রতিটি বাঁকে বিভিন্ন নিয়ম কানুনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। জাপানে এরকম ২১৩৬টি নিয়ম বা কানজি বৈশিষ্ট্য পুরো শিক্ষাজীবন ধরে শিখতে হয়। জীবনের প্রতিটি স্তরে ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হয়। সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকেও উপেক্ষা করা হয় না। এই বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দেয় 'কাইজেন' চিন্তাভঙ্গি। বিষয়টি বাংলাদেশে কয়েক যুগ থেকে চর্চিত হলেও বাংলা ভাষায় প্রাসঙ্গিক বইয়ের অভাব ছিল। সেই অভাব দূরীকরণে জনাব শেহজাদ আমান অনুবাদ করেছেন সারাহ হার্ভে রচিত বই 'কাইজেন'। বইয়ের শিরোনামের নিচে উপশিরোনাম হিসেবে লেখা হয়েছে 'জীবন বদলে দেয়ার জাপানী পদ্ধতি'। আসলেই তাই। চলার পথের বিভিন্ন বাঁধা আমাদেরকে প্রায়ই নিরাশ করে তোলে। নিরাক পরা দুপুরের মতো চারপাশ খাঁ খাঁ করতে থাকে। এরকম নিদারুণ অবস্থা থেকে উত্তরণ অনেকের কাছে পাহাড়সম মনে হয়। 'কাইজেন' মতবাদ এক্ষেত্রে পরামর্শ দেবে 'প্রথম পদক্ষেপ ফেলার'। কারণ এক পা এগিয়ে গেলে শত মাইল দূরত্বের এক মাইল কমে যায়। শত মাইল পৌঁছানো পর্যন্ত নিয়মিত চলতে হবে। চর্চা চালিয়ে যেতে হবে।

১০টি অধ্যায়ে বিভক্ত আলোচনাগুলোতে লেখক দশটি প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করেছেন। এর জন্য কোন সূচিপত্র লেখা হয়নি। অধ্যায়গুলোর শিরোনাম হল:-

  • প্রস্তাবনা
  • সূচনা
  • কীভাবে শুরু করবেন
  • কেনকো: স্বাস্থ্য
  • কাজ: শিগোতো
  • ওকেন: টাকা-পয়সা
  • আইয়ে: ঘর
  • কানকেই: সম্পর্কের বন্ধন
  • সুকানকা: অভ্যাস ও এর সাথে সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ
  • প্রতিবন্ধকতাসমূহ



বইয়ের অলংকরণ
বইয়ের অলংকরণ


বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে লেখক কাইজেনের বিস্তৃতিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। বড় কাজকে টুকরো টুকরে করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, জীবন পরিবর্তনে, জীবন পরিচালনা করা, আত্মমূল্যায়ন করতে পারতে হবে। মূল্যবোধের বিনির্মাণ জরুরী। আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে। উন্নতি হল চলমান প্রক্রিয়া, ধারাবাহিকভাবে নিজের অনুভূতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কাজের উদ্দেশ্য ও তার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আচরণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করা দরকার।

জীবনের বিভিন্ন প্রায়োগিক দিক নিয়ে এই জাপানী মনোভঙ্গিটির সূচনা হয়েছিল আমেরিকায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে। ছোট ছোট সফলতাকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার এই ধারণাটি জাপানীরা গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ পরাজয়ের পর জাপান তার প্রাচীন চিন্তাদর্শনের ছোঁয়ায় কাইজেনকে আরও কার্যকরী করে তোলে। ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাইজেনের প্রয়োগ সাফল্য নিয়ে আসে। কাইজেন চিন্তাটি জীবনের আরো ব্যাপক ক্ষেত্রে প্রয়োগের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতে থাকে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খেলাধুলা, আচরণ সবক্ষেত্রে অল্প অল্প করে উন্নতির পথে নিরবচ্ছিন্ন এগিয়ে যাওয়ার ধারণাটি সকলে কাছে ভাল লাগে। লেখকের ভাষায় -

জাপান ও পশ্চিমের ভিতর সংলাপের ধরন ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল। আর এসব সংলাপকে সক্রিয় করতে কাইজেন দর্শন ভূমিকা রাখতে পারে। এই আইডিয়াটি পশ্চিমাদের কাছ থেকেই জাপানে এসেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আবার পশ্চিমেই চলে গিয়েছিল। কেননা, জাপানে এসে জাপানি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে এটি হয়েছিল আরো শক্তিশালী। পৃষ্ঠা: ২৫


লেখক সারাহ হার্ভে ইংল্যান্ডের নাগরিক। লন্ডনের কসমোপলিটন আবহাওয়ায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। দুদন্ড অবসরের সময় ছিল না। জাপানে এসে তিনি মানুষের জীবনযাত্রার একেবারে এক ভিন্ন রূপ দেখলেন। এখনও পৃথিবীর কোন কোন সমাজ আদিম যুগে থেকে গেছে। নাগরিক সভ্যতার কোন কিছুর দেখা তারা পায়নি। এখনও এমন সমাজ রয়েছে যে সমাজ আধুনিক নাগরিক সুবিধা ব্যবহার করেও চিন্তা ও আচরণের দিক থেকে আদিম যুগে বাস করে। সেই সমাজের জীবন দর্শন, নিয়ম কানুন, নীতি-নৈতিকতা অনেকটা পরবিদ্বেষের উপর নির্মিত। বিপরীতে জাপানী সমাজ একেবারে অন্যরকম। সারাহ হার্ভে জাপানে গিয়ে একেবারে আলাদা কিছু দেখলেন, যা অনেক সভ্যতাগর্বী সমাজে দেখা যায় না। লেখকের ভাষায়-

জাপানে গিয়ে নতুন কিছু বিষয় দেখলাম। সেখানে ব্যস্ত বা জনসমাগমের জায়গাগুলোতেও বিরাজ করছিল এক ধরনের প্রশান্তির ভাব। ব্যস্ত সময়ে টোকিওর মেট্রো রেল এলাকা লোকে পরিপূর্ণ থাকত লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডের মতোই। কিন্তু জায়গা দখলের জন্য মানুষের মাঝে হুড়োহুড়ি দেখা যেত না। মালামাল বহনকারী লোকেরাও নিঃশব্দে নিজেদের কাজটা করত। রাস্তায় গাড়ির ভীড়ও একইরকম বেশি ছিল। কিন্তু কেউই বিনা প্রয়োজনে হর্ন বাজাত না বা বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালাত না। কাউকে খুব কমই আপনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দেখবেন। সেখানে ছিল শৃঙ্খলা ও অপেক্ষাকৃত কম গতির বিচরণ। পৃষ্ঠা: ৭


জীবনের এই অনন্য উপস্থাপন, জীবনদর্শনের এই গভীর বোধ লেখককে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিয়মনীতি সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। তিনি নিজের ঔৎসুক্য খোলামেলাভাবে প্রকাশ করেন। তিনি জানান-

কাইজেনের ব্যাপারে শিখে আমি প্রাচ্যের দেশগুলোকে নতুনভাবে দেখার জন্য নতুন দৃষ্টিকোণ লাভ করলাম। জানতে পারলাম ভালো থাকা ও সুখী হওয়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে নিহিত প্রজ্ঞার সম্পর্কে। আমরা বর্তমানে যাপন করি অনিশ্চিত ও ক্লান্তিকর এক জীবন। তাই এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না যে সঠিক পথের সন্ধান পাবার জন্য আমরা অন্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। আমাদেরকে আগ্রহী করে তুলতে পারে হাইজি, ল্যাগম, লাইকে বা সিসুর মতো স্ক্যান্ডিনেভিয়ার জিনিস। আর এর পাশাপাশি ইকিগাই, ওয়াবি-স্যাবি, কাকেইবো, কজন্টসুগি, শিরিন-ইয়োকুর মতো জাপানী ধারণা। পৃষ্ঠা: ৯



সারাহ হার্ভের লেখা 'কাইজেন' বইয়ের অনুবাদ বাংলাদেশে একাধিক অনুবাদকের হাত ধরে হয়েছে। নেসার আমিন সম্ভবত প্রথম বাংলাদেশে অনুবাদ করেছেন। তা সত্ত্বেও অনুবাদক শেহজাদ আমান কেন আরেকটি অনুবাদ বের করলেন, তা বোঝা গেল না। অন্যান্য অনুবাদগুলো দেখার সুযোগ না হওয়ায় তুলনামূলক আলোচনা করা সম্ভব হল না। তবে আলোচ্য বইয়ের অনুবাদের মান উন্নত, ভাষা সাবলীল। পড়তে গিয়ে কোথাও তেমন হোঁচট খেতে হয়না। এক্ষেত্রে অনুবাদক জনাব শেহজাদ আমানের অনুবাদ দক্ষতার প্রশংসা করতেই হয়। তবে তিনি কোথাও নিজের কোনো বক্তব্য প্রকাশ করেন নি।


 

কাইজেন - সারাহ হার্ভে, অনুবাদ: শেহজাদ আমান
কাইজেন বইয়ের একটি অধ্যায়ের সূচনায় থাকা অলংকরণ


'অনুবাদকের কথা বা বক্তব্য' শিরোনামে তিনি নিজের বই সম্পর্কে দু'চারকথা বলতে পারতেন। বইয়ের প্রত্যেকটি প্রধান অধ্যায়ের সূচনাতে প্রচ্ছদের মত করে কিছু অলংকরণ প্রকাশ করা হয়েছে। অলংকরণগুলো জাপানী আঙ্গিকে আঁকা, প্রত্যেকটাই নান্দনিক। রেখার কারুকার্যে মায়াবী হয়ে ওঠা অলংকরণগুলোর আঁকিয়ের নাম কোথাও পাওয়া গেল না। শিল্পীর নাম না থাকায়, এগুলো মূল জাপানী বই থেকে নেয়া, নাকি বাংলাদেশি অনুবাদ প্রকাশের সময় করা, তা বোঝা গেল না। অনুবাদক নিজের কথা বলতে গিয়ে অলংকারশিল্পী বা অলংকরণগুলোর উৎস সম্পর্কে জানাতে পারতেন। জাপানী সাংস্কৃতিক আবহ বজায় রেখে প্রচ্ছদ তৈরি করে প্রচ্ছদশিল্পী দারুণ কাজ করেছেন। বইয়ের কাগজের মান ভাল। বড় আকারের বর্ণে গাঢ় কালিতে ছাপানো। বাঁধাই বেশ শক্তপোক্ত। প্রকাশক মনোযোগ দিয়ে বই প্রকাশের কাজটি করেছেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়া দরকার।

জীবনযাপনের হ্যান্ডবুক হিসেবে বইটিকে অনেকে পছন্দ করবে। আসলেই 'কাইজেন' হল নিয়মিতভাবে অল্প অল্প করে সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ধারণা। এই ধারণা আপনি মনের মধ্যে দাঁড় করাতে পারলে সফল হবার প্রেরণা পাবেন- এটা নিশ্চিত। আর তাই, বর্তমানের হতাশাগ্রস্ত সময়ে তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের হাতে এই বই থাকা উচিত। এই বই তাদেরকে নিজেদের জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের দিশা দিবে, কাজের চাপে অস্থির হওয়া থেকে রক্ষা করবে। বুঝতে পারবে যে জীবন ও পরিবেশের সবকিছুই পরিবর্তনযোগ্য, পরিবর্তন সম্ভব। বিশৃঙ্খল জীবনকে শৃঙ্খলের মধ্যে আনা সম্ভব। ছোট বালুকার কণা আর বিন্দু বিন্দু জল যেভাবে মহাদেশ, মহাসাগর গড়ে তোলে, সেভাবে ছোট ছোট কয়েকটি সুঅভ্যাসের নিয়মিত প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনেও আসবে কাঙ্ক্ষিত ও ইতিবাচক পরিবর্তন। এইখানে 'কাইজেন' সার্থক, সফল।


-0-0-0-0-0-0-0-

কাইজেন - সারাহ হার্ভে
অনুবাদ: শেহজাদ আমান


প্রচ্ছদ: সাদিত উজজামান

প্রকাশক: প্রত্যাশা প্রকাশ, ঢাকা
পৃষ্ঠা: ১৬০
মূল্য: ৩৬০.০০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ